তালেবানের টিকে থাকা ততটা সহজ নয়।
সম্প্রতি ধীরে ধীরে আফগানিস্তানের ক্ষমতাকাঠামো নিজেদের করায়ত্ত করছে তালেবান। যদিও দেশজুড়ে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, বিক্ষোভের খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে তালেবানকে সবচেয়ে বেশি অস্বস্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। দেশ ছাড়তে আফগানদের হুড়োহুড়ি তালেবানের ফিরে আসাকে অন্তত মহিমান্বিত করছে না। বলা হচ্ছে, আফগানিস্তানের ভেতরের পুরো প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। সব মিলিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে—কোনো ফ্রন্টেই নিরঙ্কুশ সুবিধাজনক অবস্থানে নেই তালেবান।
এখন প্রশ্ন হলো, এমন ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে তালেবানের টিকে থাকা কতটা কঠিন হবে? তালেবানের টিকে থাকা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে বেশ কিছু বাস্তবিক কারণে। যদিও অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে কাবুলসহ পুরো আফগানিস্তান দখলে নেওয়ার কারণে এরই মধ্যে বিশ্বমঞ্চে দৃষ্টি কেড়েছে তালেবান। এখন তালেবান ফিরে আসায় কী হবে, তা নিয়ে নানা ধরনের পূর্বানুমান চলছে। তালেবানও নানা ধরনের বক্তব্য দিচ্ছে। এই যেমন, সদ্যই তালেবান জানিয়ে দিয়েছে, গণতন্ত্র নয়, বরং শরিয়াহ আইনেই চলবে আফগানিস্তান।

প্রথমত শরিয়াহ আইনে দেশ চালানোর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তালেবানের টিকে থাকা নিয়ে প্রথম চ্যালেঞ্জ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, তালেবান যদি গতবারের মতোই নিজস্ব কায়দার শরিয়াহ আইন দিয়ে পুরোপুরি একটি ইসলামি রাষ্ট্র গড়ার পথে শুরু থেকেই এগোতে থাকে, তবে আন্তর্জাতিক বিশ্বে স্বীকৃতি আদায় করা কঠিন হবে। কারণ, শরিয়াহ আইনের বিষয়ে তালেবানদের বিশেষ সংস্করণ বা ব্যাখ্যা আছে। সৌদি আরবের মতো সংস্কারের পথে হাঁটার বিষয় ওখানে নেই। এর সঙ্গে সঙ্গেই এসে যায় নারীদের অধিকারের বিষয়টি। এরই মধ্যে তালেবান দোহা থেকেই জানিয়ে দিয়েছে যে নারীরা শরিয়াহ আইনের আওতায় যতটুকু পাওয়ার, তা পাবেন। অর্থাৎ স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা তালেবান দেয়নি। আর সেই না দেওয়াটাই আশঙ্কা জাগায় এবং পূর্ববর্তী তালেবান শাসনে নারীর অবস্থার কথা মনে করিয়ে দেয়। এবারও যদি আগের ফর্মুলাই অনুসরণ করে তালেবান, তবে স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক বৈধতা ও সহায়তা—এ দুই–ই পাওয়া কঠিন হবে আফগানিস্তানের। কারণ, গতবারের মতো শুধু সৌদি আরব, পাকিস্তানের মতো দু–একটি দেশের স্বীকৃতিতে এবার তালেবানের দিন কাটবে না।
দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তান মানবিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে আছে। মার্কিন ডলার ডানা গুটিয়ে নেওয়ার পর থেকেই দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা সঙিন হয়ে উঠছে। আবার অন্যদিকে আছে করোনা মহামারি। করোনাভাইরাসের প্রকোপ ঠেকানোর মতো কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার অবস্থায় আফগানিস্তানের প্রশাসনিক কাঠামো নেই। আবার বর্তমান সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, আফগানিস্তানের মানুষদের মধ্যে অপুষ্টির মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে এবং প্রায় ২০ লাখ শিশুর পুষ্টিবিষয়ক বিশেষ চিকিৎসা প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, দেশ ও সরকার চালাতে তালেবানদের প্রয়োজন অর্থ। সাবেক সোভিয়েত সরকারের আমল থেকে শুরু করে হালের মার্কিন—সব সময়েই বিশ্বশক্তির তৈরি ‘পুতুল’ সরকার সব সময়ই বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিল। যেমন আশরাফ গনির সরকার মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরশীল ছিল প্রবলভাবে। কিন্তু কাবুল দখলের পর তালেবান আর সেই ডলারের দেখা পাচ্ছে না। অন্যান্য দেশ থেকে বৈদেশিক অর্থ সাহায্য পাওয়াও কিছুটা কঠিন এখন। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তালেবান মূলত অপরাধমূলক ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্থায়ন করে থাকে। এর মধ্যে আছে মাদক চোরাচালান, আফিম উৎপাদন ও বিক্রি, চাঁদাবাজি ও অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়। এভাবে বছরে ৩০০ মিলিয়ন থেকে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত আয় করে থাকে তালেবান। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বের আফিম উৎপাদনের ৮০ শতাংশই করে থাকে আফগানিস্তান। এখন তালেবান কি এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে আয় করা অর্থ দিয়ে দেশ চালাবে? যদিও তালেবানের এক মুখপাত্র সংবাদ সম্মেলনে চলতি সপ্তাহেই বলে দিয়েছেন, আফগানিস্তান আর আফিম উৎপাদক দেশ হিসেবে পরিচিতি পেতে চায় না। সে ক্ষেত্রে দেশ চালানোর জন্য অর্থ কোথা থেকে আসবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। আবার যে সংগঠন দীর্ঘদিন অবৈধ কর্মকাণ্ড দিয়ে আয় করে আসছে, সেটি কি চাইলেই তা থেকে আদৌ বেরিয়ে আসতে পারবে কি না—সেটি নিয়ে আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। আর বেরিয়ে আসতে না পারলে সেটিও তালেবানের টিকে থাকার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। চতুর্থত, আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরেই ভঙ্গুর। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা যুক্তরাষ্ট্র—যারাই আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়েছে, সবাই কাবুলকেন্দ্রিক একটি কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছে। সামগ্রিকভাবে পুরো দেশের সব কটি প্রদেশ বা জেলা ধরে ধরে রাজনৈতিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করার উদ্যোগ কখনোই নেওয়া হয়নি। ফলে আফগানিস্তানের অন্যান্য প্রদেশ ও জেলাগুলোতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাব সব সময়ই ছিল ক্ষীণ। আর এই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতা কাজে লাগিয়েই আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের বিরোধী পক্ষকে নিজেদের দলে ভিড়িয়েছে তালেবান, এক সপ্তাহের মধ্যে কাবুলের দখল নিয়েছে। তবে চলমান অস্থিরতার মধ্যে সেসব আঞ্চলিক শক্তি যে কিছুদিন পর তালেবানের বিরুদ্ধেও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না, তার নিশ্চয়তা কিন্তু নেই।
পঞ্চমত, আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক জটিল ভূরাজনীতি। তালেবানের উত্থানে প্রকাশ্যে–অপ্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছে চীন ও রাশিয়া। এটিকে মার্কিনবিরোধী একটি কর্মকাণ্ড হিসেবেই দেখা হচ্ছে। চীনের সঙ্গে স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তানের সরাসরি সীমান্ত অত্যন্ত স্বল্প দৈর্ঘ্যের। আর রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি কোনো সীমান্ত সংযোগ নেই। আফগানিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত আছে পাকিস্তান, ইরান ও তুর্কমেনিস্তানের। পাকিস্তান ঐতিহাসিকভাবেই তালেবানের ঘনিষ্ঠ। ইরানও এবার তালেবানের সরাসরি বিরোধিতা করে এখনো কোনো বক্তব্য দেয়নি। কিন্তু তালেবানের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে পুরো মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া সন্ত্রাসের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে। তালেবান তার বৈশ্বিক জিহাদ কর্মসূচি বিস্তৃত করবে কি না—তার ওপরই নির্ভর করছে এতদঞ্চলের স্থিতিশীলতা। আল–কায়েদার কিছু শাখা যেভাবে তালেবানের কাবুল দখলে অভিনন্দন জানিয়েছে, তাতে এই সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের সঙ্গে তালেবানের দহরম–মহরমের শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর আল–কায়েদাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক যদি তালেবানের অকুণ্ঠ সমর্থন পায়, তবে পশ্চিমা বিশ্বেরও তাতে কপালে ভাঁজ পড়ার কথা।
তালেবানের টিকে থাকার ক্ষেত্রে সর্বশেষ বাধা হলো তারা নিজেরাই। তালেবান একটি সুনির্দিষ্ট উগ্রবাদী আদর্শ নিয়ে কর্মী সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে চাইলেও নিজেদের ভাবনা অবিকৃতভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন। কারণ, এ ক্ষেত্রে থাকে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি, অর্থনীতির জটিল অঙ্ক। আর আফগানিস্তানের মতো দুর্বল ও ভঙ্গুর প্রশাসনিক ক্ষমতার রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেটি আরও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তালেবান নিজস্ব গোষ্ঠীর কাছে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাবুল দখল সম্ভব করেছে, সেগুলো একসময় পুরোপুরি পূরণ করা সম্ভব না–ও হতে পারে। তাতে তালেবানের ভেতরে অন্তর্কলহ সৃষ্টির শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে আফগানিস্তানে তালেবানের শাসন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। সব মিলিয়ে বলা যায় যে তালেবান যত সহজে কাবুল দখল করেছে, কাবুল রক্ষা করা তার চেয়ে ঢের ঢের কঠিন হবে। অন্তত আগের মেয়াদের মতো চললে, বছর কয়েকের মধ্যেই যে তালেবানের নতুন শত্রু তৈরি হয়ে যেতে পারে, সেটি স্পষ্ট। এখন তালেবানের নতুন নেতৃত্ব প্রতিবন্ধকতাগুলো কীভাবে মোকাবিলা করে, তার ওপরই নির্ভর করবে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ।